দেশব্যাপী প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রাণিসম্পদ প্রদর্শনী ২০২৩ অনুষ্ঠিত
“স্মার্ট লাইভস্টক, স্মার্ট বাংলাদেশ” এ শিরোনামকে প্রতিপাদ্য করে দেশের প্রাণিসম্পদ খাতের সবচেয়ে বড় আয়োজন “প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী-২০২৩” গত ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১লা মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এ সেবা সপ্তাহের অংশ হিসেবে দেশব্যাপী উন্নত জাতের পশুপাখি প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এতে বিশেষ সহযোগিতা প্রদান করে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প (এলডিডিপি)।
দুই দিনব্যাপী কেন্দ্রীয়ভাবে অনুষ্ঠেয় প্রাণিসম্পদ প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আগারগাওয়ে, পুরাতন বাণিজ্য মেলার মাঠ প্রাঙ্গনে। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী জনাব শ ম রেজাউল করিম এমপি। বিশেষ অতিথি ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সম্মানিত সচিব ড. নাহিদ রশীদ। সভাপতিত্ব করেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা: মোঃ এমদাদুল হক তালুকদার। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য প্রদান করেন জনাব এ.টি.এম মোস্তফা কামাল, অতিরিক্ত সচিব, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বিডিএফএ এবং বিপিআইসিসির সভাপতিদ্বয়।
এ উপলক্ষ্যে ঢাকা শহরকে বর্ণিল সাজে সজ্জিত করা হয়। আয়োজন করা হয় প্রাণিসম্পদের বর্তমান অবস্থা ও সম্ভাবনা বিষয়ে বেশ কটি সেমিনার। সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত এ আয়োজন ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত।
প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতাভুক্ত ৬১টি জেলার ৪৬৬টি উপজেলায় এ প্রদর্শনী একযোগে অনুষ্ঠিত হয়। এতে স্ব স্ব উপজেলা থেকে উন্নত জাতের এবং অধিক উৎপাদনশীল পশু পাখি যেমন - গাভী, বাছুর, ষাড়, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, মুরগি, হাঁস, দুম্বা, কবুতর ইত্যাদি অংশগ্রহণ করে। সৌখিন পশু পাখির উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
দেশব্যাপী আয়োজিত প্রাণিসম্পদ প্রদর্শনীতে গবাদিপশুর জন্য ১১,৮১৩টি স্টল স্থাপিত হয় যাতে ২৪,০৮৩টি উন্নত জাতের গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া ইত্যাদি স্থান পায়। আর হাঁস-মুরগীসহ অন্যান্য পোষা প্রাণির জন্য স্থাপিত হয় ৩,৬১৪টি স্টল যাতে অংশগ্রহণ করে ২৮,৭৩১টি বিভিন্ন প্রজাতির পোলট্রি ও বিশেষায়িত পাখি।
এসব পশুপাখি দেখতে আসেন ৩,৭০,০১৮ জন দর্শনার্থী। প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহের অংশ হিসেবে ৪৬,৪২১টি পশুপাখিকে টিকা প্রদান করা হয় এবং কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়ানো হয় ৫৫,৯৭৬টি প্রাণিকে। এ সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ সেবা গ্রহণ করেছেন ৬৭,৬৯৯ জন খামারি।
প্রাণিসম্পদের উন্নয়নে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রযুক্তি, ঔষধ সামগ্রী, টিকা, প্রাণী জাত পণ্য উৎপাদন ও সংরক্ষণ সরঞ্জাম, মোড়কসহ পণ্য বাজারজাতকরণ প্রযুক্তি ইত্যাদির স্টলও প্রদর্শনীতে স্থান পায়। এছাড়াও প্রাণিসম্পদের সেবা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য প্রদানের ব্যবস্থাও ছিল। এতে একদিকে যেমন খামারিরা উপকৃত হয় অন্যদিকে দর্শনার্থীরা প্রাণিসম্পদের উন্নয়ন সম্পর্কেও জানতে পারেন।
প্রাণিসম্পদ প্রদর্শনী উপলক্ষে স্থাপিত ফুড সেফটি কর্নারে, নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে সচেতনতামূলক কার্যক্রম যেমন-ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, নিরাপদ খাদ্য সামগ্রী প্রস্তুত ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও গুদামজাতকরণ এবং খাদ্যপণ্য পরিবহন ও গ্রাহক পর্যায়ে বিতরণ পর্যন্ত সার্বিক কর্মকান্ড উপস্থাপন করা হয়। প্রাণিজ উৎস থেকে খাদ্য সামগ্রী প্রস্তুতকল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সরঞ্জামাদীর কার্যকারণ দর্শনার্থীদের সামনে তুলে ধরা হয় এবং দুধ, ডিম ও মাংসজাত নিরাপদ খাদ্যপণ্য প্রদর্শনী ও বিক্রয় করা হয়। সেই সাথে নিরাপদ খাদ্যপণ্য বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে কিরূপ ভূমিকা রাখছে তা এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে খামারি ও দর্শনার্থীরা জানতে পারছেন। প্রদর্শনীর দুই দিনে প্রায় নয় কোটি টাকার প্রাণিসম্পদ পণ্য বেচাকেনা হয়।
ঢাকায় অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় প্রদর্শনীতে ভিন্ন ভিন্ন ভ্যালুচেইন ভিত্তিক প্রায় ৩০০টি স্টল স্থাপন করা হয়। বিচারক প্যানেলের সম্মুখে মডেল হিসেবে রা্ম্পের উপর দিয়ে গবাদি পশুর হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য ছিল দেখার মত। এ প্রদর্শনীর মাধ্যমে প্রাণিসম্পদের উন্নয়নের মধ্য দিয়ে খামারিদের জীবন মানে আমূল পরিবর্তন লক্ষণীয় এবং সকল শ্রেণীপেশার মানুষ এ ধরনের খামার ব্যবস্থাপনায় উৎসাহ পাচ্ছেন।
গুণ, মান, স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য, আকার, অবদান, বাজারজাতকরণ, প্রভাব ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে প্রদর্শনীর দ্বিতীয় দিন ১৪টি ক্যাটাগরিতে মোট ৮৯টি পুরস্কার, তিনটি বিশেষ সম্মাননা ও ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। সেই সাথে প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীকে দেওয়া হয় বিশেষ সনদপত্র।
ঢাকার বাইরে উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরগুলো একই রকম ভাবে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী-২০২৩ আয়োজন করে। সেবা সপ্তাহের অংশ হিসেবে উপজেলাগুলোতে একএক দিন টিকা প্রদান ক্যাম্পেইন, কৃমিনাশক ক্যাম্পেইন, স্কুল ও এতিমখানায় দুধ ও ডিম খাওয়ানোর মতো বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। সেই সাথে আয়োজন করা হয় প্রাণিসম্পদ প্রদর্শনীর। স্ব স্ব অঞ্চলের খামারিগণ দেশসেরা পশুপাখি নিয়ে প্রচন্ড উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে এ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে নিজ নিজ শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দেয়। ঢাকার বাইরে মেলাগুলোতে ছিল নিরাপদ প্রাণিজ খাদ্যদ্রব্য এবং প্রাণিসম্পদ সেবার আয়োজনও। এসব প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় মন্ত্রীবগ, মাননীয় মেয়রগণ, মাননীয় সংসদ সদস্যগণ এবং সম্মানিত সচিব, ডিসি ও এসপিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহের অংশ হিসেবে ঢাকায় উদ্বোধন করা হয় স্কুল মিল্ক কর্মসূচি। প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় দেশের ৩০০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বছরব্যাপী প্রতিদিন বিনামূল্যে দুধ পান করানো হবে।
প্রাণিসম্পদের গুণগত মান ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত ও উদ্বুদ্ধ করা এবং দেশে উৎপাদিত উন্নত পশু-পাখি ও নিরাপদ প্রাণীজাত খাদ্য সামগ্রী সবার সামনে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে প্রতি বছর এলডিডিপির আওতাভুক্ত জেলা ও উপজেলাসমূহে এ প্রদর্শনী আয়োজন করা হয়। ফলে দেশের জনগণ সচেতন হয়ে উঠছে এবং আধুনিক খামার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হচ্ছে। দেশে বেকারত্বের হার কমছে। বাড়ছে নিরাপদ প্রাণিজ আমিষের সরবরাহ।
সরকারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংস্থা যেমন বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনীকে ঘিরে চলে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের সামগ্রিক লক্ষ্য হলো প্রাণিসম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধি, দুগ্ধজাত পণ্যের বাজার সৃষ্টি, ক্ষুদ্র খামারি ও উদ্যোক্তাদের প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলায় সক্ষমতা বৃদ্ধি, জনসাধারণকে উন্নত জাতের গবাদি পশু ও হাঁস মুরগি প্রদর্শন ও অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা, বিজ্ঞান সম্মতভাবে পশুপাখি লালন পালনের কৌশল অবহিত করা, উন্নত জাতের পশু পাখি পালনের আধুনিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা এবং সর্বোপরি জনসাধারণের জন্য নিরাপদ প্রাণিজ আমিষ সরবরাহ নিশ্চিত করা।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও বিভিন্ন প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও পরামর্শক, জনপ্রতিনিধি, প্রাণিসম্পদ খাতের বিজ্ঞানী গবেষক, উদ্যোক্তা, এবং খামারিগন প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ উপলক্ষে আয়োজিত এ প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন। অসংখ্য পশুপ্রেমী, দর্শক, ছাত্র, শিক্ষক আর নানা শ্রেণীপেশার জনসাধারণের পদচারণায় মুখরিত ছিল কেন্দ্রীয় এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে আয়োজিত প্রাণিসম্পদ সেব সপ্তাহ ও প্রদর্শনীর সকল আয়োজন।
প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহের সমাপনী অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় ১ মার্চ ২০২৩ তারিখে খামারবাড়িতে অবস্থি কেআইবি অডিটোরিয়ামে।